Saturday, June 12, 2010
ড্রেসনকঃ ভুলে যাওয়া একটি ইতিহাস
যারা জীবনে কখনও আমেরিকা কিংবা ব্রিটিশ দূতবাসে ভিসার জন্য চক্কর দিয়েছেন তারা সবাই কম বেশি উপলব্ধি করতে পেরেছেন একটি উন্নত দেশে মাইগ্রেট করবার জন্য বাংলাদেশের মানুষেরা কি কঠিন পরিশ্রম অর্থ এবং সময় ব্যয় করে। দেশের নানারকম সমস্যা অভাব অনটনের দুষ্ট চক্র হতে বের হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে একটি উন্নত দেশে যাওয়ার জন্য গরিব দেশের মানুষদের এ প্রাণপণ চেষ্টা পৃথিবীর সব জায়গাতেই কমবেশি দেখা যায়, কিন্তু আমেরিকার ভারজিনিয়ার জেমস যশেফ ড্রেসনক এই প্রচলিত নিয়মকে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়েছেন নর্থ কোরিয়াতে মাইগ্রেট করে। তার এই নর্থ কোরিয়া মাইগ্রেট ও সেটেলট হবার সত্য কাহিনীর মধ্যে যেমন আছে অনেক থ্রিলার তেমনি আছে অনেক ট্রেজিডির উপাদান।
ড্রেসনকের জন্ম হয় ১৯৫১ সালে তবে তার শৈশব জীবন মোটেও সুখকর ছিল না পাঁচ বছর বয়সকালেই ড্রেসনকের মা বাবার মধ্যে ডিভোর্স হয় তার ৯ বছরের বড় ভাইকে নিয়ে তার মা তাকে বাবার কাছে সঁপে পেনসিলভানিয়াতে চলে যান, বাবার আশ্রয়ে কিছুদিন থাকলেও তার কৈশরে পা রাখার সাথে সাথে তার বাবা তাকে এতিম খানায় রেখে আসেন, ড্রেসনক সেখানে কিছুকাল অতিবাহিত করলেও তার বয়স যখন ১৭ হয় তখন আর্মিতে নিজের নাম লিখান, আর্মিতে কর্মরত অবস্থায় ড্রেসনক এক সুন্দরী মার্কিন ললনাকে বিয়ে করেন প্রথমদিকে তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হলেও ড্রেসনকে তার পেশাগত কারণে ২ বছরের জন্য জার্মানিতে গমন করেন জার্মানি হতে ফিরে ড্রেসনক উপলব্ধি করেন তার স্ত্রী অন্য এক ব্যক্তির সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত যা ড্রেসনকে জীবনের প্রতি চরম হতাশাগ্রস্ত করে তুলে।
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত জীবনের সেই সময়ে ড্রেসনক মার্কিন আর্মিতে প্রাইভেট ফার্স্ট অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, এরই মধ্যে ১৯৬০ সালে নর্থ কোরিয়া এবং সাউথ কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হলে আর্মি তাকে নর্থ কোরিয়া এবং সাউথ কোরিয়ার মধ্যবর্তী Korean Demilitarized Zone এ প্রেরণ করে, ড্রেসনক সেখানে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করবার সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তা ব্যক্তিদের সাথে নানা বিষয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন, এক পর্যায়ে অতিরিক্ত মধ্যপান, জুয়া খেলা নানা অভিযোগে তাকে কোর্ট মর্ষাল করবার প্রস্তুতি নেয় আর্মি । কিন্তু ড্রেসনক তা আগে ভাগেই টের পান এবং সীমন্ত ক্রস করে নর্থ কোরিয়া পালিয়ে গিয়ে নতুন করে জীবন আরম্ভ করবার পরিকল্পনা করেন , ১৯৬২ সালের ১৫ আগস্ট লাঞ্চ বিরতির সময়ে মিলিটারী ক্যাম্প হতে বের হয়ে সবার অজান্তে পায়ে হেঁটে বর্ডার ক্রস করে নর্থ কোরিয়াতে যান এবং নর্থ কোরিয়ার সৈন্যদের কাছে ধরার দেওয়ার মাধ্যমে আরম্ভ হয় ড্রেসনকের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের।
বিশ্ব দরবারে আমেরিকান সরকারের কাছে ড্রেসনকের এভাবে নর্থ কোরিয়াতে পালিয়ে যাওয়াটা চরম একটি বিব্রতকর ঘটনা হলেও নর্থ কোরিয়ার সরকারের কাছে তা ছিল একটি বিরাট আদর্শিক বিজয় একারনে তারা ড্রেসনককে সাদরেই নিজের দেশে গ্রহণ করে জামাই আদরে রাখে, ড্রেসনকের পরে অনুরূপ ভাবে ল্যারি এলেন, জেরি পারিস, চালস রবাট নামে চারজন আমেরিকান সৈন্য নিজেদের পক্ষত্যাগ করে নর্থ কোরিয়াতে পারি জমায় যা নর্থ কোরিয়ার সরকারকে আমেরিকা বিরোধি প্রচার চালানোর সুযোগ করে দেয়, এ চার আমেরিকানকে নর্থ কোরিয়ান সরকার নিজেদের টিভি রেডিও ম্যাগাজিনে আমেরিকা বিরোধি প্রোপাগান্ডার উপাদানে পরিণত করে ।
প্রথম দিকে ড্রেসনক সহ বাকি আমেরিকানরা নর্থ কোরিয়ান সরকারের অর্থায়নে বিলাসি জীবন যাপন করলেও কিছু দিনের মধ্যে লোকালদের সাথে ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক বৈসাদৃশ্য সহ্ নানা সমস্যার কারণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ইউরোপে পালানোর পরিকলপনা নেয় ১৯৬৬ সালে এই লক্ষ্যে তারা সোভিয়েত দূতাবাসের কাছে আশ্রয় চায় কিন্তু দূতবাসের কর্মচারিরা তাদের নর্থ কোরিয়ার সরকারের কাছে হস্তান্তর করে দেয় চার মার্কিনির এই হটকারিতার জন্য সরকার প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তাদেরকে গৃহবন্দী করে মগজ ধোলাই বা political indoctrination করবার উদোগ নেয় ( একটি রুমের মধ্যে আটকে রেখে ২৪ ঘণ্টা রেডিও শুনতে বাধ্য করা, কঠিন কায়িক শ্রম প্রদানে বাধ্য করা, সরকারি পুস্তিকা লিফলেট মুখস্থ করতে বাধ্য করা)
ড্রেসনকের বাকি সহকর্মিরা এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও এমনকি একজন আত্মহত্যা করলেও, ড্রেসনক পুরা বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জ রূপে গ্রহণ করেন এবং জীবনকে নতুনভাবে আরম্ভ করবার দৃর সংকল্প নেন ধীরে ধীরে তিনি কোরিয়ান ভাষা ও সংস্কৃতি আয়ত্ত করতে থাকেন কঠিন অধ্যবসায়ের মাধ্যমে । তার এই চেষ্টায় নর্থ কোরিয়ান সরকার সন্তুষ্ট হয়ে তার গৃহবন্দী অবস্থার অবসান করে এবং পিয়ন ইয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী ভাষা শিক্ষার দায়িত্ব প্রদান করে, শিক্ষকতার পাশাপশি, ড্রেসনক বহু কোরিয়ান সিনেমাতে মার্কিন খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন ১৯৭৮ সালে Usung Heroes সিনেমায় তার খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য সমগ্র নর্থ কোরিয়ায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।
ড্রেসনক বর্তমানে পিয়ন ইয়ং এর একটি এপার্টমেন্ট কোরিয়ায়ন স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত জীবন যাপন করছেন। ৭০ দশকের পরে ড্রেসনকের কথা পশ্চিমা মিডিয়া ভুলে গেলেও ২০০৬ সালে ব্রিটিশ তথ্যচিত নির্মাতা ডানিয়েল এবং নিকলাস ড্রেসনকের জীবনীর উপর ভিত্তি করে Crossing the Line নামে একটি ডকুমেণ্টরী তৈরি করেন, এর ফলে ড্রেসনক আবারও পশ্চিমা মিডিয়ায় লাইম লাইটে চলে আসেন।
সম্প্রীতি তিনি মিডিয়াতে দেওয়া এক সাক্ষ্যতকারে বলেন, জীবনের এই সন্ধিক্ষনে এসে তিনি আর নতুন করে পশ্চিমা দেশে যেতে দিতে আগ্রহি নন, তিনি জানান বর্তমানে তার অবসর সময় কাটছে লেকে মাছ ধরে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment